খোরশেদ আলম (রনি) রায়পুর (লক্ষ্মীপুর): রায়পুরে সুপারি ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন হত্যা মামলায় দুই আসামি মেহেদি হাসান রুবেল ও ফয়েজ আহম্মদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। আজ মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দুপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ রহিবুল ইসলাম এ রায় দেন। মামলার অপর আসামি সিএনজি চালক মো. সাগর নিরাপরাধ হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে আদালত।
লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, আসামি রুবেল ও ফয়েজ টাকার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলমগীরকে হত্যা করে। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগে প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই ফয়েজ পলাতক রয়েছে। রায়ের সময় দণ্ডপ্রাপ্ত রুবেল ও খালাসপ্রাপ্ত সাগর আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত রুবেল দত্তপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম বটতলি গ্রামের ছিদ্দিকুর রহমানের ছেলে ও ফয়েজ একই এলাকার আবদুল্লাহর ছেলে। রুবেল ও ফয়েজ সম্পর্কে চাচাতো ভাই।
আদালত সূত্র জানায়, ভিকটিম আলমগীর রায়পুর উপজেলার বামনী ইউনিয়নের সাইচা গ্রামের মৃত বশির উল্যার ছেলে। রুবেলের সঙ্গে তার সুপারি ব্যবসা ছিল। ব্যবসায়ীক লেনদেনে রুবেলের কাছ থেকে তিনি ১৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা পাওনা হন। এদিকে রুবেল আইপিএল ক্রিকেটে জুয়া খেলে ৮ লাখ টাকা হারায়। টাকা হারিয়ে তিনি মানসিকভাবে দুঃশ্চিন্তায় পড়েন। এরমধ্যে রুবেল ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট তার চাচা হারুনুর রশিদকে ৫ লাখ ও আলমগীরকে ৬ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রতি দেয়। কিন্তু রুবেল ৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পারে। এতে রুবেল তার চাচাতো ভাই ফয়েজকে ডেকে বিষয়টি জানায়। তখন তারা আলমগীরের কাছ থেকে টাকা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। পরে ধরা পড়ার ভয়ে তারা হত্যার পরিকল্পনা করে। ২০ আগস্ট আলমগীর টাকার জন্য ফোন দিলে রুবেল তাকে সদর উপজেলার মান্দারী বাজার একটি ফাস্টফুডের দোকানে আসতে বলে। এরআগেই ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে দুপুর পৌনে ৩টার দিকে রুবেল ও ফয়েজ ফাস্টফুডে আসে। কিছুক্ষণ পরই আলমগীরও ওই দোকানে আসে। তখন ফয়েজকে ছোটভাই বলে তার সঙ্গে রুবেল পরিচয় করে দেয়। এসময় রুবেল তার ভাই ফয়েজকে তিনটি কোমল পানীয় আনতে বলে। তিনিটি মিরিন্ডা (কোমল পানিয়) নিয়ে একটি মধ্যে ফয়েজ ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। ঘুমের ওষুধ মেশানো পানীয় আলমগীরকে খেতে দেয়। মুখ খোলা মিরিন্ডা খেতে আলমগীর অনীহা প্রকাশ করলে সেখান থেকে রুবেলও একটু খায়। বাকিটা আলমগীর খেয়ে নেয়।
অন্যদিকে ৩ লাখ টাকা এনেছে বলে রুবেল বাকি টাকার জন্য আলমগীর ও ফয়েজকে নিয়ে সাগরের
সিএনজি অটোরিকশাযোগে মিয়ারবেড়ি এলাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। সেখানে না থেমে তারা ইলিশ মাছ কেনার জন্য কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়নের মেঘনা নদীর মতিরহাট এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এরমধ্যেই ঘুমের ওষুধের প্রভাবে আলমগীরে চোখে ঘুমের ভাব দেখা দেয়। মতিরহাট তাকে মারা হলে ধরা পড়ার ভয় রয়েছে। দাম বেশি হওয়ায় সেখান থেকে তারা ইলিশ না কিনেই চলে আসে। সিএনজির পেছনে রুবেল ও ফয়েজের মাঝখানে তাকে বসানো হয়। পরে তারা সেখান থেকে বিভিন্ন সড়ক দিয়ে জেলা শহরের উত্তর তেমুহনীতে আসে। এসময় আলমগীর নেমে যেতে চায়। তখন রুবেল বলে, আপনি অসুস্থ, আমরাই আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দেব। একথা বলে তাকে নিয়ে সদর উপজেলার দালার বাজার ইউনিয়নের মিলগেইট এলাকায় নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে প্রথমে ধারালো ছুরি দিয়ে গলায় আঘাত করে ফয়েজ। এসময় আলমগীরকে রুবেল ঝাপটে ধরে রাখে। একপর্যায়ে ফয়েজ তার পেটে উপর্যপুরি আঘাত করলে তিনি মারা যান। এতে সিএনজি চালক সাগর প্রতিবাদ করলে তাকেও হত্যার হুমকি দেয়। এ ভয়ে সে আর কিছু বলেনি। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাজির দিঘীরপাড় এলাকার একটি পুকুরে তার মরদেহ ফেলে দেয়। আর ৩ লাখ টাকা থেকে ফয়েজকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে রুবেল বাড়িতে চলে যায়। সিএনজি চালককে হুমকি দিয়ে যায় এ ঘটনায় কাউকে কিছু বললে তাকে হত্যা করবে। পরদিন আলমগীরের ভাসমান মরদেহ পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তার ছোটভাই হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে অভিযোগ দায়ের করে। এ ঘটনায় সিএনজি চালক সাগরকে গ্রেপ্তার করলে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেয়। পরবর্তীতে পুলিশ রুবেলকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। ঘটনার পর থেকেই ফয়েজ পলাতক রয়েছে। ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (নিঃ) জাহাঙ্গীর আলম আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। দীর্ঘ শুনানি ও ১৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আদালত দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়।
মামলার বাদী হুমায়ুন কবির বলেন, আমি ভাই হারিয়েছি। বাবার মতো তিনি আমাদের আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু আসামিরা তাকে মেরে ফেলেছে। আমি এ রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।
Leave a Reply