নিউজ ডেস্ক :
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে শিক্ষকদের কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।
রোববার (৩১ জুলাই) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিকেএসএফ ভবনে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন, ২০২২ বিষয়ে নাগরিক সমাজের ‘অবস্থানপত্র’ নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন কাজী খলীকুজ্জমান। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মোর্চা গণস্ববাক্ষরতা অভিযান এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে সহয়তা করে তাদেরই ব্যানার ‘এডুকেশন ওয়াচ’। কাজী খলীকুজ্জমান এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপার্সন।
তিনি পিকেএসএফেরও চেয়ারম্যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষার উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতার প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী।
খলিকুজ্জামান ও রাশেদা আত্মীয়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশর সব সরকারি বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাকে ব্র্যাকের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি সদস্য কাজী ফারুক আহমেদ। চিনিচোরখ্যাত এরশাদের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের ভাই কাজী ফারুক গণস্বাক্ষরতার সুবিধাভোগী। শিক্ষানীতি নিয়ে একটি বুকলেট বের করে প্রচুর টাকা পান গণসাক্ষরতার কাছ থেকে।
কাজী ফারুকের বিরুদ্ধে কল্যাণট্রাস্টের কোটি কোটি টাকা চুরি প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিজ্ঞতার সনদ জালিয়াতি করে শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ধরা পড়ার পর চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। কিন্তু তিন দাবি করতেন বিএনপি-জামাত সরকার অন্যায়ভাবে তাকে চাকরিচ্যুত করেছেন। কাজী ফারুক নিজেও একটি এনজিও চালান। সেই এনজিও গঠনের সময় যেসব শিক্ষক নেতার ব্যবহার করেছিলেন, অনুমোদন ও অনুদান পাওয়ার সেই নেতাদের বাদ দিয়ে দেন। কাজী ফারুকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের সব তথ্যপ্রমাণ দৈনিক শিক্ষার হাতে রয়েছে।
গণস্ববাক্ষরতার সংবাদ সম্মেলনে কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, ‘আমাদের পরিষ্কার অবস্থান হচ্ছে, এটি (নোট গাইড-কোচিং-প্রাইভেট) ক্ষতি করছে। বলেছি, মোটেও কোচিং চলবে না। আমরা চাই, শিক্ষা মানে বুঝতে হবে, চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে। কোচিং যদি থাকে, সেটি করার সুযোগ নেই। যদি নোট বুক থাকে, তাহলে সেটি করার সুযোগ নেই। তবে একটি সহায়ক বই থাকতে পারে, অতীতেও ছিল। কিন্তু সেটির ওপর নির্ভর করে যদি পরীক্ষা হয় এবং আরেকজন শিক্ষক যদি কোচিংয়ের মাধ্যমে সেটি গিলিয়ে দেন, তাহলে তো শিক্ষা হবে না।
বর্তমানে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম নোট-গাইড পড়ে মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়া এবং জিপিএ-৫–ভিত্তিক বলে মন্তব্য করেন কাজী খলীকুজ্জমান। তিনি বলেন, এখানে শিক্ষা কীভাবে হয়? একটি হচ্ছে, নোট-গাইড পড়ে মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়, জিপিএ-৫–ভিত্তিক শিক্ষা। পরীক্ষা দিতে দিতে শেখার সময় নেই। শিক্ষার্থীর মা–বাবা, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়, কতটা জিপিএ-৫ পেল? কাজেই জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য মুখস্থ করানো হয়। এর বাইরে কিছু জানে না। কিন্তু আসল শিক্ষা হচ্ছে, যা পড়ে বোঝা যাবে, বোঝার পর বিবেচনায় এবং চিন্তা-ভাবনা করতে হবে এবং প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে। এটিই সারা বিশ্বে হয়, কিন্তু এখানে এটির সুযোগ নেই, নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর আগে জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। এ বিষয়ে কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, তাঁরা চান খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষা আইন হওয়া উচিত। না হলে শিক্ষানীতির আলোকে অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবে তাঁরা চান শিক্ষা আইনের নতুন খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর আগে আবারও সেটি জনগণকে জানানোর জন্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হোক। আর সেটি একেবারেই সম্ভব না হলে জাতীয় সংসদে পাঠানোর আগে হলেও যেন সেটি জনগণকে জানানো হয়।
সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতি হলো, এখন পর্যন্ত তা কতটা বাস্তবায়ন হলো বলে মনে করেন? জবাবে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির এ কো–চেয়ারম্যান বলেন, শিক্ষানীতির অনেক কিছু করা হয়েছে। আবার অনেক কিছুই করা হয়নি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের অনেক প্রশিক্ষণ হয়েছে, তবে অনেক দূর বাকি। শিক্ষকদের বেতনও বেড়েছে। তবে মৌলিক কিছু বিষয় হয়নি। যেমন শিক্ষা আইন না হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যায়নি। স্থায়ী শিক্ষা কমিশন হয়নি।
শিক্ষানীতির অনেক কিছু বিশেষ করে শিক্ষা আইন না হওয়ায় অসন্তুষ্ট প্রকাশ করেন কাজী খলীকুজ্জমান। তিনি বলেন, ১২ বছর ধরে শিক্ষা আইন নিয়ে কাজ হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু একটি আইন করতে যদি ১২ বছর লাগে বা ১২ বছরেও না হয়, তাহলে যাঁরা এটি বাস্তবায়ন করেন, তাঁদের বিষয়ে বড় প্রশ্ন আছে।
সংবাদ সম্মেলনে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শিক্ষা আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গেছে কি না, তা সরকার তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। এ জন্য তাঁদের প্রধান দাবি হলো, যদি এটি চূড়ান্ত হয়েও থাকে, তাহলেও যেন এটি জনসমক্ষে প্রকাশ এবং মতামতের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কোচিং–বাণিজ্য কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়া যাবে না। তবে যেসব কোচিং সেন্টারে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টিউশনি করিয়ে অর্থ আয় করার সুযোগ পান, সেগুলো চলতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের বিধান অনুযায়ী শিক্ষকরা নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট টিউশন করাতে পারবেন না। তবে আইনের এই বিধান মানা হচ্ছে কি না তা মনিটর করার কোনো বিধান রাখা হয়নি। এই বিষয়টি উত্থাপন করে রাশেদা কে চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষক তার নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট টিউশন করাচ্ছেন কি না তা মনিটর করবে কে?
Leave a Reply