এস আর,সোহেল রানা,রাজশাহী,প্রতিনিধিঃ
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠা কারখানা থেকে তৈরী আন্তর্জাতিক মানের পণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে আজ বিশ্বের ৮টি দেশে রপ্তানি করে তাক লাগিয়েছে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিধবা পল্লী নামের থানাপাড়া সোয়ালোজ।
সুইডেন ভিত্তিক আর্ন্তজাতিক দাতা সংস্থার সহযোগীতায় গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানটি তাঁতের কাপড় দিয়ে পন্য তৈরী ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী নির্যাতন, বাল্য বিয়ের বিষয়ে এলাকায় বাপক উন্নয়ন ঘটিয়ে আজ দেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে ব্যাপক ভুমিকা রেখেছে।
দেশ স্বাধীনের পর এসব বিধবা ও দুস্থদের কল্যানের জন্য এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ’দি সোয়ালোজ থানাপাড়া প্রজেক্ট’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান চালু করা হয় । তারই ধারাবাহিকতা অংশ হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটি ১৭ অক্টোবর ৫০ বছর পুর্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজনের মাধ্যমে কেক কেটে শুভ উদ্ভোধন পালন করা হবে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক রায়হান আলী।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ১৩ই এপ্রিল এই থানাপাড়া গ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রায় ৪শ পুরুষ পাকহানাদারের গুলিতে শহীদ হন । ফলে এ গ্রামের অনেক নারী, সন্তান হারা ,স্বামী হারা হয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বিধবা গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দেশি-বিদেশী বন্ধুদের হাত ধরে সেই গ্রামটি এখন তাতঁ বস্ত্রশিল্প এর জন্য এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে খ্যাতি পেয়েছে।
বিধবা নামে পরিচিত গ্রামটি ঘুরে দাড়ানোর গল্পের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দা সোয়ালোজ ইন সুইডেন। যা পরবর্তীতে থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামে এই প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নারী ও শিশুদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে ।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে দেশের পুর্নবাসনের অংশ হিসেবে সুইডেনের এই সাহায্য সংস্থাটি প্রথমে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করে । তারপর পরিকল্পনা মোতাবেক হস্তশিল্প ও প্রাথমিক শিক্ষাসহ জৈবকৃষি, নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রকল্প চালু করে। বিধবা ও দুস্থ মহিলাদের পরিবারের বাচ্চাদের বিনাপয়সায় শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দেয় । যা আজও অব্যাহত আছে । আর এ কার্যক্রমের মাধ্যমে চারঘাট ও বাঘা উপজেলার বেশ কিছু গ্রামের অসহায় মানুষ আত্ননির্ভরশীল হয়ে ওঠে ।
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রায় দুই শতাধিক নারী পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে । বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ হাত ধরে যুদ্ধবিধস্ত গ্রামটির ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করে। ৭১ -এ স্বজন হারানো এ গ্রামের নারীরা এখন অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন শতাধিক নারী পুরুষের কর্মসংস্থানে কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে এই কারখানাটি অবস্থিত। তবে কেউ চরকা ঘুরিয়ে সুতা কাটছেন, কেউ কাপড় বুনছেন, কেউ কাপড়ে মাড় দিচ্ছেন অথবা কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে বুনানো কাপড়ে নকশী করছেন। কারখানায় শুধু সুতাটাই বাইরে থেকে ক্রয় করা হয়। বাকি সবই শ্রমিকেরা করে থাকেন। সকল প্রকার গার্মেন্টেসের পাশাপাশি নকশী কাঁথাও তৈরী করা হয় এখানে।
এখানকার তৈরীকৃত হস্তজাত পণ্য উন্নত দেশগুলোতে রফতানি করা হয়। বিদেশের যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থানাপাড়ার হস্ত শিল্প ক্রয় করে থাকে সেগুলো হলো ফেয়ার ট্রেড কোম্পানি জাপান, পিপল ট্রি ইংল্যান্ড, স্টিকসেন সুইডেন, বেওলা লন্ডন ইউকে, বেএন্ডফে ইউকে, টুয়াইন তাইওয়ান, ফেয়ারট্রেড কোরিয়া, হেয়ারলুম ইউএসএ, আফ্রো আর্ট সুইডেন, সাসটেইনেবুল ইয়োরস সুইডেন, প্রজেক্ট ট্রি জার্মান।
এছাড়া দেশীয় উন্নত শপিংমলগুলোতেও এই হস্তশিল্প জায়গা করে নিয়েছে। সমবণ্টন নীতিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে শ্রমিকেরা সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকে।
নারীদের আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি নানা রকম উন্নয়নমুলক কর্মসূচিও রয়েছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে হস্তশিল্প প্রকল্প, গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প, প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ডে-কেয়ার এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া এসব কর্মসূচির আওতায় রয়েছে তা হলো স্থায়িত্বশীল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, আইন শিক্ষা, আর্সেনিক পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার, দক্ষতা উন্নয়ন, উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা এবং পারিবারিক সহিংসতা রোধ প্রকল্প। প্রকল্পের আওয়তায় আশেপাশের দশটি গ্রামে ঝড়ে পড়া শিশুদের নিয়ে একটি করে স্কুল তৈরি করা হয়েছে।
সংস্থার সুবিধাভোগী জাহানারা বেগম নামের একজন প্রায় ৩৫ বছর ধরে কারখানায় কাজ করছেন। তার পরিবার ১৩ এপ্রিল ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার। বাবা নিহত হওয়ার দু’বছর পর জাহানারার মা কারখানায় যোগদান করেন। বয়স হলে মায়ের সঙ্গে তিনিও চাকরি নেন। চাকুরি নেয়ার দু’বছর পর বিয়ে হয় জাহানারার। জমানো টাকা দিয়ে সারদা বাজারে স্বামীকে দোকান করে দিয়েছে জাহানারা।
তিনি বলেন, সোয়ালোজ সোসাইটি এখানকার নারীদের চোখ খুলে দিয়েছে। স্বজন হারিয়ে গ্রামের নারীরা দিশেহারা ছিল। সেই শোক শক্তিতে রূপ দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান বলে জানা তিনি।
সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক রায়হান আলী আরো বলেন, ‘যুদ্ধের পর গ্রামের নারীরা অনেকটাই অসহায় ছিল। এই প্রতিষ্ঠান এখানকার নারীদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এখন নারীরা হস্তশিল্পের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশেষ পরিচিতিও অবদান রেখেছেন। ৫০ বছর পুর্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন সম্পন্ন প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
Leave a Reply