সোহেল রানা,রাজশাহী,প্রতিনিধি:
রাজশাহী জেলায় আঞ্চলিক নাম বরেন্দ্র অঞ্চল। বরেন্দ্র অঞ্চলে বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অত্যাধিক খরা। রয়েছে পানি সংকট। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বজ্রপাত। এই অত্যাধিক খরা মোকাবেলায় লোকায়িত পদ্ধতিতে তাল গাছের রস সেবন করে খরা মোকাবেলা করতেন বরেন্দ্র এলাকার মানুষেরা। শুধু তাই নয় তাল গাছের নানান রয়েছে ব্যবহার। বরেন্দ্র এলাকায় শীত মৌসুমে তাল গাছের রস দিয়ে গুড় বানিয়ে পিঠা উৎসব প্রত্যেকটি বাড়ির একটি ঐতিহ্য। তাল গাছের কাঠ দিয়ে বরেন্দ্র এলাকার মাটির বাড়ি নির্মাণ করা হয়। যা খরা মোকাবেলার জন্য অত্যন্ত কার্যকারী। আরো হয় তাল পাতার পাখা। তালের পিঠা তো বরেন্দ্র অঞ্চলের একটি সুস্বাদু খাবার। এবং তালগাছ অনেক খরা সহনশীল।
তানোর পৌরসভার ৫ নং তালান ইউনিয়নের মোহর গ্রামে রয়েছে ফসলি কৃষি জমি ও মানুষের বসতি স্থান। মোহর গ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ লোকই কৃষক যারা প্রতিনিয়ত কোন না কোন কৃষি কাজে মাঠে থাকতে হয়। বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাত প্রতিবছরের ঘটনা। বজ্রপাতে প্রতিবছর মানুষসহ প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অবকাঠামো সুরক্ষা, বজ্রপাতের হাত থেকে এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষা ও বরেন্দ্র এলাকায় খরা মোকাবেলা ও নানান ধরনের পিঠার সংস্কৃতি ধারণ করে বারসিক’র দিকনির্দেশনায় মোহর স্বপ্ন আসার আলো সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্যরা বিগত 7/8 বছর ধরে নিজেরা তাল বীজ রোপণ করার পশাপাশি এলাকার মানুষকে সেগুলো রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় মোহর কাশিম বাজার, লছিরামপুর, শুকদেবপুর, দেবিপুর, রাস্তার দুই পাশে প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকায় কয়েক হাজার তাল গাছর বীজ রোপণ করা হয়।বর্তমানে এলাকার মানুষের তত্ত্বাবধানে গাছগুলো বেড়ে উঠছে। এই কর্মউদ্যোগের ফলে এলাকার মানুষের ঐতিহ্য আর স্থানীয় সম্পদ নির্ভর কর্মক্ষেত্র বিকশিত হওয়ার পাশপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবর্তীত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৈরি হচ্ছে আপন সম্পদ ও চর্চা নির্ভর এক স্থায়িত্বশীল ক্ষেত্র, যা এলাকার প্রাণ ও সম্পদ সুরক্ষায় কার্যকরি অবদান রাখবে বলে এলাকার মানুষ বিশ্বাস করে।
মোহর স্বপ্ন আসার আলো সংগঠনের ও গ্রামের সচেতন জনগণ, সরকারের নির্বাচিত সদস্য, ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক, এবং উদ্যোগে গত ৮ বছর ধরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে তাল বীজ সংগ্রহ করেন বপনের জন্য। গ্রামের লোকজন নিজেরা তালবীজ রোপণ করার পাশপাশি যুব ও স্বেচ্ছাসেবকদের দেওয়ার জন্য তাল বীজ সংরক্ষণ করেন। এসব সংঘবন্ধ যুবদের গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীরাও তাল বীজ রোপণে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করেন। এলাকার প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় বর্তমানে বৃক্ষরোপণ একটা সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। ফলে এলাকায় দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে তাল গাছের চারা। শুধু রাস্তায় নয় বাড়ির আশেপাশেও অনেক তালগাছে চারা দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় অন্যান্য উদ্যোগ গ্রহণ করছে যেমন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ,যৌতুক প্রথার প্রতিরোধ, মাদক, প্রাচীন বৃক্ষ সুরক্ষায়, নিজ এলাকার রাস্তা সংস্কার, নৈতিক শিক্ষা, নবীন প্রবীণ আড্ডা, নিরক্ষর মুক্ত গ্রাম , হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মশান, ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলার,প্রাকৃতকি ও সামাজিক সংকট মোকাবেলায় এলাকার যুব সমাজের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এইসব সংকট মোকাবেরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসচেতনতা, নারীর সামাজিক নিরাপত্তা, সুরক্ষিত হচ্ছে প্রান্তিক পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সরকারি সেবা পরিসেবায় গ্রামের প্রান্তিক পরিবাররের অংশিদারিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেদের আদান প্রদানের সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার ভেতর দিয়ে সুদৃঢ় হচ্ছে সামাজিক বন্ধন, বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক সংকট মোকাবেলার সক্ষমতা।
বিগত প্রায় ১৪ এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কর্মকৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সহায়কের ভূমিকা পালন করছে বারসিক। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকার যুব সমাজ, পেশাজীবী আগ্রহী জগোষ্ঠীর এলাকার প্রাকৃতিক ও সমাজিক সংকট মোকাবেলা হচ্ছে। এই কর্মপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, সরকারি সেবাদানদানকারী প্রতিষ্ঠান ও গ্রামের জনগোষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে বাড়ছে ঐক্য । আর এই ঐক্য বাড়ার মধ্যে দিয়েই , সমাজে অনেক ধরনের কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মানুষ সুবিধা।
Leave a Reply