ফরহাদ হোসেন, সাভার প্রতিনিধি:
আজ ২৯ অক্টোবর, বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এ বছরের বিষয়বস্তু হলো, ক্রীড়ার আবেগময় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্ট্রোক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্ট্রোক প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
বাংলাদেশে স্ট্রোক রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য গবেষণার তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, যাদের অনেকেই যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। এর মধ্যে একটি গুরুতর ঝুঁকি হলো ডিসফাজিয়া বা গলধঃকরণ সমস্যা, যা সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যায় প্রায় ৭০ জন স্ট্রোকের কারণে মারা যান, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। স্ট্রোক পরবর্তী ধাপে গলধঃকরণ সমস্যা দেখা দিলে তা থেকে অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি হয়, যা দ্রুত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের যে অংশগুলো গলধঃকরণের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, খাবার বা তরল শ্বাসনালীতে প্রবেশ করতে পারে, যা শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোক আক্রান্ত ২০-৫০% রোগীর মধ্যে গলধঃকরণ সমস্যা দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা না পেলে এই সমস্যার কারণে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
ডিসফাজিয়ার কারণে শ্বাসনালীতে খাবার ঢুকে তাৎক্ষণিক শ্বাসরোধ বা অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া হতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী। আমাদের দেশে প্রায়ই এই সমস্যা উপেক্ষিত হয়, যার ফলে রোগীরা ঝুঁকিতে থাকেন। তাছাড়া, ভুল খাবার খাওয়ানোর নির্দেশনা বা খাবারের ভুল ঘনত্ব রোগীর অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়।
এক্ষেত্রে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সঠিকভাবে খাবার খাওয়ানোর নির্দেশনার ও খাবারের ঘনত্বের পরিবর্তন করে রোগীর গলধঃকরণ সমস্যার জন্য স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসক রোগীর গলধঃকরণ জটিলতা নির্ণয় করে তার জন্য সঠিক মূল্যায়ন এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করেন, এর ফলে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়।
বাংলাদেশে এখনও স্ট্রোক রোগীদের গলধঃকরণ সমস্যা যথাযথভাবে চিহ্নিত ও চিকিৎসা করা হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতিটি স্ট্রোক রোগীর ক্ষেত্রে গলধঃকরণ জটিলতার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের দেশে তা উপেক্ষিত। এর একটি অন্যতম কারণ হলো, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন পাস করা হলেও এখন পর্যন্ত আইন অনুযায়ী পাঁচ বছর মেয়াদী ব্যাচেলর অফ সাইন্স ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কোর্স সম্পন্নকারী ব্যক্তিদের লাইসেন্স প্রদান করা হয়নি। লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করতে হবে, যাতে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পান এবং অপচিকিৎসার শিকার না হন।
যে সকল সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রস্তাবনা দরকার তা হলো ১.গলধঃকরণ জটিলতা মূল্যায়ন: স্ট্রোক রোগীদের ক্ষেত্রে গলধঃকরণের প্রাথমিক মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত। ২. লাইসেন্স প্রদান: বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন অনুযায়ী পাঁচ বছর মেয়াদী ব্যাচেলর অফ সাইন্স ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কোর্স সম্পন্নকারী ব্যক্তিদের অনতিবিলম্বে লাইসেন্স প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ৩. প্রথম শ্রেণী মর্যাদায় নিয়োগ: দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদায় স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ৪. স্ট্রোক পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন: দেশে স্ট্রোক পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে রোগীদের বিশেষায়িত স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসা এবং ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসা দেওয়া হবে। ৫. সচেতনতা বৃদ্ধি: স্বাস্থ্যকর্মী ও জনগণের মধ্যে গলধঃকরণ জটিলতার গুরুত্ব ও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
আমরা যদি সকলে মিলে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তাহলে স্ট্রোক রোগীদের মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব এবং আমরা স্ট্রোকের চেয়ে বড় হতে পারবো।
লিখেছেন রিয়াদ মাহমুদ, চতুর্থ বর্ষ (ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি), স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিভাগ (চিকিৎসা অনুষদ, ঢাবি), বিএইচপিআই-পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)।