মোঃ জুলহাস উদ্দিন হিরো, স্টাফ রিপোর্টার।
শেরপুরের গারো পাহাড়ের সীমান্তে নদী নালা, খাল বিল ঝর্ণা, ফসলি জমি, জলাশয়, বন বিভাগের পাহাড় ওনদীর পাড় ভেঙে নির্বিচারে চলছে বালু লুটের মহোৎসব।
ফলে গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পরেছে। জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেষে অবস্থিত গারো পাহাড়ের পাদদেশে সৌন্দর্য্যের নীলাভূমি প্রাকৃতিক খনিজ ও বনজ সম্পদে ভরপুর শেরপুরের গারো পাহাড়। যে সৌন্দর্যকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশ বিনোদন কেন্দ্র, নালিতাবাড়ির মধুটিলা ইকোপার্ক ও পানিহাতা পর্যটন কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রগুলোতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠে গারো পাহাড়। সৌন্দর্য উপভোগ করতেই দর্শনার্থীদের এ আগমন। এসব কেন্দ্রগুলো থেকে সরকারের ঘরে আসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব । কিন্তু এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোর আসপাশের এলাকায় স্থানীয় বালুদস্যুরা ভোগাই,চেল্লাখালি,মহারশি ও সোমেশ্বরী,কর্ণঝোড়া ও কালঘোষা নদীসহ বিভিন্ন স্থানে শতশত ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পরিবেশের ভারসাম্যের ক্ষতি সাধন করে অবাধে বালু লুটপাট করে আসছে। এতে সৌন্দর্য হারাচ্ছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। এতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যও হুমকির সম্মুখীন। এসব বালু লুটপাটের বিষয়টি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল। নদীর পাড় ফসলি জমি, বনবিভাগের পাহাড় কেটে নির্বিচারে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা মূল্যের বালু লুটপাট করা হচ্ছে। উত্তোলনকৃত বালু দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। বালুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ এখন বালু লুটপাটে সাথে জরিত। বালু ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে প্রতিট্রাক বালু ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। গতবছর যে বালু বিক্রি করা হয়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়। বর্তমানে বিক্রি করা হচ্ছে ৬০ হাজার টাকায়। বালুর দাম বৃদ্ধির কারন হিসেবে জানা গেছে, মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় শেরপুরের গারো পাহাড়ের বালুর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে গতকয়েক মাসে বালু লুটপাট করে গারো পাহাড়ের অনেই কোটি প্রতি বনে গেছেন।
স্থানীয়দের মতে নদীগুলোর ইজারাকৃত নির্ধারিত স্থানে এক দুই মাস বালু উত্তোলনের পর সেখানে আর বালু থাকে না। পরে বালুখেকোরা ভরবছর ইজারা বহির্ভূত এলাকায় বালু লুটপাট চালান। এ অভিযোগ স্থানীয়বাসীন্দাদের । অভিযোগ রয়েছে বালুখেকোরা কখনো প্রশাসনের যোগশাজসে আবার কখনো গায়ের জোরে দীর্ঘদিন ধরে দিনেরাতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা মূল্যের বালু লুটপাট করে আসছে । সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করা গেছে বর্তমানে নাকুগাঁও স্থলবন্দর থেকে শুরু করে কর্ণঝোড়া পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকায় ও শেরপুর সদর, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী সদরসহ বিভিন্ন হাটবাজার গ্রামেগঞ্জে,পাড়া মহল্লায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বাড়ি বাড়িও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের সামনে বসানো হয়েছে অবৈধ বালুর হাট। এসব স্থান থেকে প্রকাশ্যে বাধাহীনভাবে বিক্রি করা হচ্ছে বালু। অভিযোগ রয়েছে, বালুদস্যুরা প্রভাবশালী হওয়ায় বালু লুটপাটের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে বা প্রতিবাদ করতে সহস পান না। আবার কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের উপর নেমে আসে বালুদস্যুদের কালো থাবা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বালু লুটপাট প্রতিরোধে অভিযান করতে গিয়েও হিমসিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে। অভিযানে গিয়ে আওয়ামী লীগের দোসর খেতাবে ভূষিত হয়ে নাকানিচুবানি খাচ্ছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি ইউএনও ও এসিল্যান্ড। সাংবাদিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। পত্রিকায় লেখালেখি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাংবাদিক খেতাবে ভূষিত হয়ে হুমকিধমকির শিকার হওয়ার ও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়,গত ৫ আগষ্টের পর নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানা প্রশাসনের কাজের অংশ হিসেবে বালু লুটপাট বন্ধে অবস্থান নেন। তাকে প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালাতে হয় বালু লুটপাট বন্ধে । অভিযোগ রয়েছে তাকে কোনভাবে দমাতে না পেরে বালুখেকোরা নানা অযুহাতে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে নামে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের দোসর খেতাব প্রাপ্ত হয়ে গতমাসে বদলি হতে হয় তাকে । অবৈধ বালুর গাড়ি আটক করে আওয়ামী লীগের দোসর খেতাব পান ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেলসহ স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক । জানা যায়, গত ২৭ জানুয়ারি রাতে ঝিনাইগাতী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) অনিন্দা রানী ভৌমিক উপজেলা সদরের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ বালুর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন। এসময় অবৈধ বালু ভর্তি একটি গাড়ি আটকসহ ৪ শ্রমিককে ১০ দিনের করে কারাদণ্ড দেন। এঘটনায় বালুদস্যুরা উপজেলা পরিষদ ঘেড়াও করে সাজা প্রাপ্ত শ্রমিকদের ছারিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেলকে আওয়ামী লীগের দোসর খেতাব দিয়ে তাকেসহ স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় বলে জানায় উপজেলা প্রশাসন । পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। বন বিভাগের নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান বন এলাকা থেকে বালু লুটপাট বন্ধে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে তারা হুমকিধমকির মধ্যে রয়েছেন।
ময়মনসিংহ বনবিভাগের ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া ফরেষ্ট রেঞ্জে কর্মরত সহকারি বন সংরক্ষক এসডি মো,তানভীর আহমেদ ইমন বলেন লোকবলের অভাবে ও নিরাপত্তাজনিত কারনে বল এলাকা থেকে পাথর বালু লুটপাট বন্ধ করতে তাকে হিমসিম খেতে হচ্ছে । তবে লোকবল বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ।
জানা গেছে, ,আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৫ বছরও বালু লুটপাট করা হয় ইজারা বহির্ভূত এলাকা থেকে। তবে সে সময় শুধু নদীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে নতুন করে অসংখ্য বালু মহালের আবির্ভাব ঘটেছে। থেমে নেই বেপরোয়াভাবে বালু লুটপাট। বালুদস্যুদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পরেছে নদীর পাড়, বনবিভাগের পাহাড়, খালবিল নদী- নালা, ফসলি জমি। নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারনে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পরেছে নাকুগাঁও স্থলবন্দর, নদীর তীরবর্তী জনবসতি,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বুরুঙ্গা সেতুসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সৌন্দর্য হারাচ্ছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। নির্বিচারে বালু লুটপাট ও অবাধ ভারি যানবাহনে বালু সরবরাহের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে গারো পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আয় থেকে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, বাংলা ১৪৩২ সালের ১ বৈশাখের পূর্বেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভোগাই,চেল্লাখালি, মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর ৪টি বালু মহাল ইজারা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চেল্লাখালি নদীর বুরুঙ্গা অপর বালু মহালটি ইজারা দেয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ বালু মহালটি সরাসরি বিএনপি নেতাকর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করে আসলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেয়া ৪টি বালু মহাল আওয়ামী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই চলছে ।
তবে ওই চারটি বালু মহালের ইজারাদারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থীত অন্যান্য যেসব শেয়ারদার ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা বালু মহালের শেয়ারদার নেই। তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন বিএনপি’র নেতা-কর্মিরা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বালু উত্তোলনে অনেকটাই নীতিমালা অনুসরণ করা হলেও বর্তমানে কোন নীতিমালা মানা হচ্ছে না ।
নির্বিচারে নদীর পাড়, ফসলি জমি খালবিল,নদী নালা,বনবিভাগের ছড়া, ঝর্ণা বনবিভাগের সামাজিক বনের আনাচে কানাচে খালবিল, নদী নালাসহ বিভিন্ন জলাশয়ে নতুন নতুন অসংখ্য বালু মহালের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে। এসব বালু মহাল থেকে বেপরোয়াভাবে নির্বিচারে দিনেরাতে প্রতিদিন কোটি টাকা মূল্যের বালু লুটপাট করা হচ্ছে।
জানা যায় বালু মহাল ইজারার শর্থ ও নিয়ম অনুযায়ী ইজারাকৃত নদীর নির্ধারিত স্থানের নদীর তলদেশ থেকে উর্বর বালু উত্তোলনের কথা। কিন্তু ইজারাদারের লোকজন ইজারার শর্থের প্রতি তোয়াক্কা না করে নদীর তলদেশে ও নদীর পাড় ভেঙে ফসলি জমি ও পাহাড়ে ৫০/৬০ ফুট গর্ত করে অবাধে বালু লুটপাট চালিয়ে আসছে। জানা যায়, বালু মহাল ইজারার নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইজারা বাতিলের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা না করে ইজারা বহির্ভূত এলাকার বালু লুটপাট বন্ধে অভিযান পরিচালনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে প্রশাসন । কিন্তু কিছুতেই বালু লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না। স্থানীরা জানান, একদিকে অভিযান করা হচ্ছে। অন্যদিকে বালু লুটপাট করা হচ্ছে। আবার অভিযান করে প্রশাসনের লোকজন চলে আসার পর সেখানে আবারও শুরু হচ্ছে বালু লুটপাট।
অভিযানে ধ্বংস করা হচ্ছে বালু উত্তোলন যন্ত্র। দেয়া হচ্ছে জরিতদের কারাদণ্ড। করা হচ্ছে জরিমানা। কিন্তু এর পরেও কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ বালু লুটপাট। নালিতাবাড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) আনিসুর রহমান বলেন প্রশাসনিক কাজের ৮০ ভাগ সময় দিতে হচ্ছে বালু লুটপাট প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা করতে। ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল বলেন বালু লুটপাট বন্ধে অভিযান করা হচ্ছে। আরো করা হবে। শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাবের আহমেদ বলেন অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন ২ ফেব্রুয়ারি রবিবার সোমেশ্বরী নদীর রাঙ্গাজান ও কর্ণঝোড়া নদীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫০ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়েছে। তার মতে অবৈধ বালু লুটপাট বন্ধে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা আক্তার ববি বলেন ডিসেম্বরে তিনি যোগদান করেন। এরপর থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে তিনি ১০ টি অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন একদিকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। অভিযান করে চলে আসার পর সেখানে আবারও শুরু হচ্ছে বালু উত্তোলন। তারমতে যারা অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে সহযোগিতা করার কথা তারাই বালু উত্তোলন করছে। তিনি আরও বলেন সীমান্তে কর্মরত বিজিবি, বনবিভাগসহ সুশীল সমাজের সকালের সহযোগিতা ছাড়া বালু লুটপাট বন্ধ করা সম্ভব না। অবৈধ বালু লুটপাট বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহন সম্পর্কে জানতে শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরদার মাহমুদুর রহমানের সাথে কথা বলতে ফোনে বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন বিজি পাওয়া গেছে ।
Leave a Reply