সোহেল রানা,রাজশাহী,প্রতিনিধি:
রাজশাহীতে ‘পুকুর খনন সন্ত্রাসীরা’ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটে কৃষকের জমি নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে চলছে পুকুর খননের মহাযজ্ঞ। ফলে জেলাজুড়ে উজাড় হচ্ছে তিন ফসলি উর্বর কৃষিজমি। ইতোমধ্যেই জেলায় ৪০ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে। পাশাপাশি কৃষিজমিতে সৃষ্টি হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। এ কারণে দেশের শস্যভান্ডারখ্যাত রাজশাহীতে কমছে ফসল ও সবজি উৎপাদন। এমনকি ফলের বাগান কেটেও চলছে মৎস্য চাষের লক্ষ্যে পুকুর খনন। কৃষিজমি কমার কারণে সচ্ছল কৃষক ক্রমাগত আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। খাদ্যাভাবের শঙ্কাও রয়েছে। জেলার আটটি উপজেলায়ই একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে।
পবা: পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া মাঠে একই সঙ্গে পাশাপাশি তিনটি পুকুর খনন চলছে। এর ফলে প্রায় ৪০ বিঘা আবাদি জমির ফসল ও সবজি নষ্ট হয়েছে। এসব পুকুর খননের আগে জমিতে পেঁয়াজ, ভুট্টা, ধান, কাঁচামরিচ ও বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ ছিল। রোববার দুপুরে সরেজমিন এ চিত্র দেখা গেছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মেহেদী হাসান সাজু নামের এক যুবক। তিনি পুকুরের মাটি ট্রাক্টরে বহন করে বাইরে বিক্রি করছেন। পুকুর খননের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তিনটি পুকুর খনন করছেন নয়ন, প্রিন্স এবং সোহেল। এদের মধ্যে সোহেল বড়গাছি ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি। প্রিন্স ওয়ার্ড ছাত্রদলের নেতা এবং নয়ন বিএনপি কর্মী। তারা সবাই জেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব আল আমিন হোসেনের সমর্থক।বক্তব্যের জন্য পবার ইউএনও আরাফাত আমিন আজিজকে তিনবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাহিদ হাসান বলেন, ইউএনও স্যার বড়গাছি এলাকায় অভিযানে (সোমবার দুপুর সোয়া দুইটা) আছেন। এ কারণে হয়তো ফোন ধরেননি। তবে পুকুর খনন বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এদিকে বড়গাছির কারিগরপাড়ায় চলছে ২০ বিঘা জমিতে আরেকটি পুকুর খনন। এটি খনন করছেন আরঙ্গ নামের একজন ব্যক্তি। আরঙ্গ পবার পুকুর খনন সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য।এর পাশেই বড়গাছি সাকোপাড়ায় চলছে ২২ বিঘা আয়তনের আরেকটি পুকুর খনন। এটি খননের সঙ্গে সম্পৃক্ত বড়গাছি হাট এলাকার বাসিন্দা বিএনপিকর্মী সুজন। পাশেই কালুপাড়া মোড়ে ১৭ বিঘা জনিতে আরেকটি পুকুর খনন চলছে।নওহাটা পৌরসভা নওহাটা পৌরসভার বসন্তপুর এলাকায় ২২ বিঘা জমিতে পুকুর কাটছেন পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আজাদ আলী। বড়গাছি কানপাড়ায় ২৫ বিঘা এবং পবার বাগসারা এলাকায় ৫০ বিঘা জমিতে পুকুর কাটছেন আজাদ। ৫ আগস্টের পর তিনি পবার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় তিনশ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করেছেন। আজাদ পবায় পুকুর খনন সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা বলে জানা গেছে। পুকুর খননের বিষয়টি স্বীকার বেপরোয়া পুকুর খনন সন্ত্রাসীরা করে যুবদল নেতা আজাদ বলেন, আমি এবং দলের নেতাকর্মীরা বসন্তপুরে শুধু নওহাটা পৌর বিএনপির সভাপতি রফিক ভাইয়ের একটি পুকুর কেটেছি। তাছাড়া পবার পারিলায় পেয়ারা বাগান কেটে ৩০ বিঘা জমিতে পুকুর কাটছেন পবা উপজেলা স্বোস্থ্যসেবক দলের সদস্য সচিব মুসতাক আহমেদ। বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি পুকুর কাটিনি। সংস্কার করছি মাত্র। কৃষিজমিতে পুকুর খনন হচ্ছে জানানো হলে তিনি বলেন, যে পুকুরটি সংস্কার করা হচ্ছে, সেটির পার্শ্ববর্তী কিছু কৃষিজমি নেওয়া হয়েছে।বাগমারা বাগমারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক স্থানে পুকুর খনন চলছে। উপজেলার গণিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মনিরুজ্জামান রঞ্জু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তার এলাকায় শতবিঘা জমিতে পুকুর খনন করেছেন। বর্তমানে তার নেতৃত্বে ইউনিয়নের পোড়াকায়ায় ৫০ বিঘা কৃষিজমিতে পুকুর খনন চলছে। বাগমারা উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক মহব্বত হোসেনের বিরুদ্ধেও পুকুর খনন, মাছ লুট এবং চাঁদাবাজির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের
পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি সম্প্রতি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। বর্তমানে মহব্বত মাধাইকুড়ি এলাকায় ৪৫ ও ৩০ বিঘা আয়তনের দুটি পুকুর খনন করছেন। বাগমারায় পুকুর খননের বিষয়ে ইউএনও মাহবুবুল আলম বলেন, বাগমারা অনেক বড় এলাকা। খননকারীরা গভীর রাত টার্গেট করে। প্রত্যন্ত এলাকায় গভীর রাতে অভিযান চালানো সমস্যা হচ্ছে। তারপরও আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
তানোর জেলার তানোর উপজেলায়ও দেদারসে চলছে পুকুর খনন। উপজেলার চান্দুড়িয়া ইউনিয়নের নাইস গার্ডেন নামের একটি পার্কসংলগ্ন এলাকায় ২০ এবং ২৫ বিঘা আয়তনের দুটি পুকুর খনন চলছে। উপজেলার তালন্দ এলাকার বাসিন্দা সোনার কাজী নামের এক ব্যক্তি পুকুর খনন করছেন। এছাড়াও বাঁধাইড় ইউপির বৈদ্যপুরে ৮ বিঘা উপজেলার মুন্ডমালা পৌর সদরের উত্তরপাড়ায় আফসার প্রামাণিক নামে এক বাক্তি ২০ বিঘার পুকুর খনন করছেন। এ ব্যাপারে তানোরের ইউএনও লিয়াকত সালমান বলেন, দুটি পুকুরের খননকাজ বন্ধ করা হয়েছিল। যদি আবারও খনন শুরু করে তাহলে অভিযান চালানো হবে। এ ব্যাপারে কেউ ছাড় পাবে না। দ্রুত কমছে কৃষিজমি এদিকে পুকুর খননের ফলে
দ্রুতহারে কমছে কৃষিজমি। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্যে জানা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রাজশাহীতে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৮০ হেক্টর। ২০২৪ সালে আবাদযোগ্য জমি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। অর্থাৎ ১৭ বছরে রাজশাহী জেলায় আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৩৬ হাজার ২২ হেক্টর। ২০২৫ সালে এসে সেটি ৪০ হাজার হেক্টর হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহীর উপপরিচালক মোসা, উম্মে ছালমা বলেন, কৃষিজমিতে পুকুর খনন বন্ধে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষিজমির শ্রেণি বদল করে পুকুর খনন পুরোপুরি বেআইনি। কিন্তু সুযোগসন্ধানীরা অত্যন্ত কৌশলী। তারা পুকুর খনন করছে। ফলে রাজশাহীতে কৃষিজমি কমছে। কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফসল ও ফল উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
Leave a Reply